শুক্রবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০১২

জন্মদিন


 
জীবনে কেবল একবারই কারো জন্মদিনে উপস্হিত থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়ি। স্কুলের এক বন্ধু, যার বাবা চা-বাগানের কোন কর্মকর্তা ছিল তার জন্মদিন। গিয়ে দেখি আমার বন্ধুটির মাথায় চানাচুরঅলার টুপি পড়িয়ে সঙ সাজিয়ে বিশাল এক কেকের সামনে ছুরি হাতে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। কেক কাটা ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভানো এবং সমবেত ইংরেজী গান গাওয়া ইত্যাদি দৃশ্যগুলিকে খুবই অরুচিকর ও হাস্যকর লেগেছিল। ভাল লেগেছিল কেবল ঘরের ভেতর টাঙানো রঙীন বেলুনগুলো কেননা রঙীন বেলুন কেনার মতো সামর্থ্য তখন আমার ছিলনা।

বৃহস্পতিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১২

বালা কাপানি


বালা কাপানি। বালা কাপানি হলো কৃষিনির্ভর মণিপুরি সমাজের একটি ঐতিহ্যবাহী কৃষি অনুষঙ্গ। যৌথ কৃষিপদ্ধতি মণিপুরিদের আদিম স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজব্যবস্থার অংশ ছিল। প্রাকৃতিক ভূমিকে যৌথ প্রয়াসে বাসভূমি ও চাষভূমিতে পরিণত করে চাষবাস এবং উৎপাদন প্রথায় ভোগ বন্টনও ছিল সাম্যভিত্তিক। লকেই-সাগেই-শিংলুপ ভিত্তিক সমাজে একমসয় ব্যক্তিকে ছাপিয়ে যৌথ চেতনাই প্রবল ছিল; পরস্পরের প্রতি সাহায্য সহযোগিতা ছিল একেবারেই ব্যক্তিস্বার্থ বিবর্জিত। মণিপুরিদের আদিধর্ম 'আপোকপা' কঠোরভাবে এই যৌথচেতনার অনুষঙ্গী। সেই স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজব্যবস্থা আজ নেই, কিন্তু যৌথ চেতনা আজো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এখনো খেতখামার বা গেরস্তালি কাজে কিংবা ঘরদোর তৈরীতে তারা বিনা পারিশ্রমিকে পরস্পরকে সাহায্য করে থাকে। এ সমাজে ব্যক্তিচেতনা যৌথচেতনাকে পুরোপুরি গ্রাস করেনি তার উদাহরন হলো বালা কাপানি। বালা কাপানির মুল উদ্দেশ্য গৃহস্থকে ধান কাটায় সাহায্য করা। মুলত তরুন কৃষক ও কৃষানীরা দল বেঁধে 'বালা' গঠন করে। বালাগুলো গ্রাম থেকে গ্রামে এমনকি দুর-দুরান্তেও ধান কাটতে যায়। মণিপুরি গৃহবধুরা বালা নিয়ে নিজেদের বাপের বাড়ীতে সাহায্য করতে যায়। ধান কাটা শেষ হলে বালা দলটিকে 'বান্দারা' বা ভুড়িভোজ খাইয়ে আপ্যায়ন করার নিয়ম। ছবিটি Tarini Singha এর সৌজন্যে পাওয়া।

মঙ্গলবার, ২০ নভেম্বর, ২০১২

লেহু

 


লেহু। মণিপুরিদের সবচেয়ে প্রিয় শাক। সিলেটিরা বলে লাইশাক। গাছ আর ফুল দেখতে সরিষা গাছের মতো, পার্থক্য হলো বড় হলে পাতাগুলো অনেক প্রশস্ত হয়ে যায়। স্বাদও কিছুটা সরিষা শাকের মতোই তবে ঝাঁঝ সরিষা থেকে অনেকগুণ বেশি। কাঁচা লাইশাক মুখে দিলে ঝাল লাগে।

লাইশাক ভেজে খাওয়া যায়। ভর্তা খাওয়া যায়। আলু বেগুন বা অন্য সবজির সাথে মিলিয়ে লাবড়া বা ঙউথং খাওয়া যায়। মণিপুরিরা খাবারের সাথে কাঁচা লাইশাকের কচি ডগা কামড়ে খেতে পছন্দ করে। লেহুর কচি ডগার সাথে সেদ্ধ আলু আর শুটকি মিশিয়ে তৈরি হয় মণিপুরি সালাড সেঞ্চু।মাছের সাথে বিশেষ করে বোয়াল মাছের সাথে লাইশাকের রান্না তুলনাহীন। লাইফুল দেখতে হলুদ এবং অসাধারন সুন্দর।

ঢাকার কোন বাজারে এই শাক পাওয়া যায় না এরচেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কি হতে পারে?

শুক্রবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১২

দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানোই মানবতা

পরপর ঘটে যাওয়া দুইটি ঘটনায় মনটা প্রচন্ড বিষন্ন হয়ে আছে। প্রথমটি কমলগঞ্জে মণিপুরি শিক্ষক রবীন্দ্র কুমার সিংহের খুন হওয়া। পুজামন্ডপ থেকে ফেরার পথে স্ত্রী ও দুই শিশুর সামনে সিএনজি থেকে নামিয়ে গুলি করে মারা হয় রবীন্দ্রকে। ছেলেটি জামার পকেট থেকে পুজায় জমানো ৪০ টাকা বের করে মুখোশধারী সন্ত্রাসিদের দিয়ে বলে এগুলো নিয়ে তার বাবাকে ছেড়ে দিতে। ছোট ছেলেটির আব্দার সন্ত্রাসীরা রাখবে কেন? দ্বিতীয়টি রাউজানে মারমা নারীর ধর্ষিত হওয়া। হলদিয়া রাবার বাগান এলাকায় স্বামীকে বেঁধে রেখে তার সামনেই গর্ভবতী মারমা নারীটিকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে যুবলীগের ৪ সন্ত্রাসী। রাস্তাঘাট বেডরুম দুই জায়গাতেই নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ রাষ্ট্রের ভুমিকা নিয়ে কথা বলতে গেলে কিছু নাগরিক হয়তো প্রশ্ন তুলবেন এরকম ঘটনা তো দেশের সবখানেই অহরহ ঘটছে সেসব নিয়ে বিমর্ষ হন না কেন। সংখ্যাগরিষ্ট ও সংখ্যালঘু, নিপীড়ক ও নিপীড়িত, জাতি ও উপজাতি, সবল ও দুর্বল পার্থক্যগুলো তো রাস্ট্রই ঠিক করে দিয়েছে ভাই। আমরা নিজেরা না বললে কে এসে বলে দেবে আমাদের দুঃখ-কষ্ট-গঞ্ছনা-দুর্দশার কথা? দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানোই তো মানবতা।

বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১২

ELA আয়োজিত বিপন্ন ভাষামেলায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি

 


অনেক খারাপ খবরের ভীড়ে আজ একটি ভাল খবর শেয়ার করি। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত বিপন্ন ভাষামেলার আলোচনা সেশনে বাংলাদেশের প্রান্তিক জনপদের একটি ভাষা স্হান পেয়েছে। ভাষাটির নাম বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি। পৃথিবীর বিপন্ন ভাষাগুলোকে রক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে নিউইয়র্কে পালিত হয়েছে বিপন্ন ভাষামেলা। বিপন্ন ও বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলোকে নিয়ে কাজ করা এনডেঞ্জারড ল্যাঙ্গুয়েজ এলায়েন্স (ELA) গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরীতে এই ভাষামেলার আয়োজন করে। বিপুল সংখ্যক আগ্রহী দর্শক, ভাষাকর্মী ও ভাষাতাত্বিকের উপস্হিতিতে ভাষামেলায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিপন্ন ভাষাসমুহের প্রতিনিধিরা তাদের ভাষার পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন। বাংলাদেশ থেকে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার প্রতিনিধিত্ব করেন উত্তম সিংহ। অনলাইনভিত্তিক ফেসবুক গ্রুপ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ডিসকাশন ফোরাম (BMDF) এবং পৌরি ইন্টারন্যাশনাল এর সক্রিয় তৎপরতায় ভাষামেলায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। উল্লেখ্য বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাকে ইতিমধ্যে UNESCO এনডেঞ্জারড ল্যাঙ্গুয়েজ ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত করেছে।

উত্তম সিংহ তার বক্তব্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার বৈশিষ্ঠ্য এবং অপরাপর ভাষাসমুহের সাথে এই ভাষার তুলনামুলক চিত্র তুলে ধরেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন ভাষভিত্তিক এথনোলোগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে প্রায় ৪০,০০০ ভাষিক সংখ্যালঘু বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় কথা বলেন। এছাড়া ভারতের আসাম ত্রিপুরা ও মণিপুরে ৩৬০,০০০ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি বাস করে। ব্যবহারিক চর্চার অভাব, আঞ্চলিক বৃহৎ ভাষাসমুহের প্রভাব, রাস্ট্রিয় উদাসীনতা ইত্যাদি নানান কারণে ভাষাটির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।

মঙ্গলবার, ২ অক্টোবর, ২০১২

সাগর সরোয়ার



 নোটিফিকেশন থেকে জানলাম আজ ফেসবুক বন্ধু সাগর সরোয়ারের জন্মদিন। মৃত মানুষকে কিভাবে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে হয় জানিনা। একদিন হয়তো আমিও থাকব না, আমার ওয়ালে এসে বন্ধু শুভাকাঙ্খীরা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে যাবে - ভাবলেই মন বিষাদে ভরে যায়। সাগর সরোয়ারকে চিনতাম না, কখনও দেখিনি। মাঝে মধ্যে আমার পোস্টগুলোতে এসে কমেন্ট রেখে যেতেন, বিশেষ করে আদিবাসী বিষয়ক পোস্ট গুলোতে। মৃত্যুর পরে জেনেছি তিনিই বিখ্যাত সাংবাদিক সাগর সরোয়ার। কতটা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করছি আমরা? মানুষ যদি নিজের বেডরুমের ভিতরেও নিরাপদ থাকে না তাহলে কোথায় নিরাপদ থাকবে মানুষ? আমরা আপনার নিরাপত্তা দিতে পারিনি, সাগর সরোয়ার, পারিনি আপনার হত্যার বিচার করতে। জন্মদিনে আপনার নিকট একটাই প্রার্থনা, আমাদের এই নির্লজ্জতা ও অক্ষমতাকে নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন।

বুধবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২

ডুকলা সম্প্রদায়


ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধানে ‌'ডুকলা' শব্দের অর্থ দেখানো হয়েছে অসভ্য,নিকৃষ্ট জাতি বা সম্প্রদায়। সিলেট অঞ্চলে ডুকলা শব্দটি গালি হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। ডুকলা বা শব্দকরেরা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। তাদের প্রধান পেশা হলো ঢোল ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র বাজানো। কুল, ভীল, শবর, মুন্ডাদের মতোই ডুকলারা প্রাচীন ভারতবর্ষের একটি অনার্য জনগোষ্ঠি। ডুকলারা বর্তমানে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত তবে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের কাছে তারা অচ্ছ্যুত এবং অস্পৃশ্য। বাঙালি বর্ণহিন্দুরা ডুকলাদের হাতে জল খায় না, নিজেদের চেয়ারে বা বিছানায় ডুকলাদের বসতে দেয় না, বাঙালিদের সাথে তারা বড়জোড় প্লে­ট ছাড়া বিশেষ কাপে চা খেতে পারে। দোকানে বা অন্য কোথাও সবার সাথে বসে কোনো কিছু খাওয়া বারণ। তাদের সাথে একঘরে ঘুমালে, একসাথে উঠলে বসলে, একসাথে খেলে, হাতের রান্না বা জল খেলে অন্যদের জাত চলে যায়!

সমকালীন ইতিহাসে দারিদ্রের যে সীমারেখা চিন্হিত করা হয় ঢুকলারা তার থেকে বহু নীচুস্তরে বাস করে। কেউ গৃহহীন। কারো নিজের শরীরটা বাদে কোন সম্পদ নেই। কেউ ভিক্ষা করে সংসার চালায়। শব্দকর সমাজ আজন্ম দারিদ্রকে নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে। তাদের সন্তানদের চোখেও কোন স্বপ্ন নেই। ছেলেমেয়েগুলো জন্মের পর থেকে নানান দৃশ্য ও অদৃশ্য বাধার সম্মুখীন হয়ে, বৃহৎ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রবল হীনমন্যতাবোধ নিয়ে বড় হতে থাকে। তারা অবধারিতভাবেই ধরে নেয় মা-বাবারা যেভাবে নিদারুন দারিদ্র ও হতাশার মধ্যে জীবন কাটায়, তারাও সেভাবে জীবন কাটাবে। তাদের বিশ্বাসে গেঁথে থাকে অদ্ভুত এক সত্য যে, এই দুর্দশার জন্য হয়তো কোন দেবতার অভিশাপ দায়ী, অথবা ঈশ্বর নিজেই চান না তারা ভাল থাকুক।

রাস্ট্রে জনসংখ্যা দমন যখন একটা প্রধান সমস্যা, তখন ডুকলাদের জন্মের চেয়ে মৃত্যুহারই বেশী। তো ডুকলাদের নিয়ে রাস্ট্রের কোন সমস্যা নেই সুতরাং তাদের খবর রাষ্ট্র রাখে না। এভাবে অবহেলা, বঞ্চনা ও সামাজিক বৈষম্যের জাঁতাকলে পড়ে ভূমিপুত্র ডুকলারা হারাতে থাকে নিজেদের অস্তিত্ব, জীবন, জীবিকা, ঢোল, বাদ্য সবকিছু। নিশ্চিহ্ন হতে থাকে মানুষ আর মানুষের জনপদ, মানুষেরই দাপটে!